10:34
0
গ্রামীণ দর্পণ ডেস্ক, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ : নাম বাঁধনহারা, অথচ এটিই আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্নে বেঁধেছে অনাহারে অর্ধাহারে থাকা বন্ধন হারানো অনাথ শিশুদের। হয়ে উঠেছে সুবিধাবঞ্চিত শিশু-কিশোরদের নিরাপদ ঠিকানা। বাঁধনহারায় লেখাপড়া করে তারা; করে সংস্কৃতিচর্চা। আবার কর্মসংস্থানও খুঁজে নেয় এখান থেকে।
কোথায় এই বাঁধনহারার বসত? অনন্য সামাজিক সাংস্কৃতিক এ সংগঠনের অবস্থান ঢাকার অদূরে নরসিংদীতে। অনাথ শিশু-কিশোরদের পশ্চাৎপদ জনপদ থেকে তুলে আনে সংগঠনটি। বিনা পয়সায় লেখাপড়া শেখায়। জীবিকা অর্জনের পথ দেখায়। বঞ্চিত শিশু-কিশোরদের ফিরিয়ে আনে সমাজের মূল স্রোতে। সরকারি প্রশাসনের উদ্যোগে কর্মসংস্থান ও শিক্ষা প্রদানকারী এমন কোনো সাংস্কৃতিক সংগঠন পরিচালনার উদাহরণ দেশের ৬৪ জেলার অন্য কোথাও নেই।
নরসিংদীর জেলা প্রশাসক আবু হেনা মোরশেদ জামান জানান, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর শিশু-কিশোরদের লেখাপড়া ও অর্থ উপার্জনের ব্যবস্থা করে বাঁধনহারার সদস্য। এসব ব্যয় নির্বাহে ২০১৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর চালু হয়েছে বাঁধনহারা ফুডস। নরসিংদীর অন্যতম মানসম্মত এ রেস্টুরেন্টে সম্মানির বিনিময়ে কাজ করে সংগঠনের সদস্যরা। তারা ক্রেতাদের সামনে খাবার পরিবেশন করে। তাদের দরিদ্র বাবা-মাও কাজ করেন এ রেস্টুরেন্টে। নরসিংদীর জেলা প্রশাসক নিজেই এটি প্রতিষ্ঠা করেছেন।
বাঁধনহারার যাত্রা শুরু হয় নরসিংদীর সাবেক জেলা প্রশাসক ওবায়দুল আজমের অনুপ্রেরণায়, ২০১২ সালের ২৫ মার্চ। স্থানীয় জেলা প্রশাসনের পৃষ্ঠপোষকতায় সংগঠনটির আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ ঘটে ২৬ মার্চ। এর নিয়মিত সদস্য ৫০। খণ্ডকালীন ৩০। বাঁধনহারা সদস্যদের একজন রিশাদুর রহমান রিশাদ। এক অন্ধ শিল্পীর ছেলে সে। অভাব-অনটনের সংসারে অন্ধ বাবা-মার পাশে দাঁড়াতে সংবাদপত্র বিক্রি করে রিশাদ। তাতেও সংসারের অভাব ঘোচে না। লেখাপড়া বন্ধ থাকে। একদিন তাকে খুঁজে নেয় বাঁধনহারা। তার জীবন বদলে যায়। কাজ জোটে বাঁধনহারা ফুডসে। এখান থেকে আয় করা অর্থেই এখন সংসার চলে তাদের। অবসরে সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের মাধ্যমে নিজেকে পরিশুদ্ধ করে রিশাদ। স্বপ্ন দেখে সামনে এগিয়ে যাওয়ার।
ঝুমন সরকার, শারমিন আক্তার, তামান্না আক্তার, আসমা আক্তার সাথী ও শাহীন ভূঁইয়াও রিশাদের মতো বাঁধনহারা ফুডস রেস্টুরেন্টে ক্রেতাদের খাবার পরিবেশন করে। সেখানে কাজ করেন রাকিবা আক্তারের মা শিরিন বেগম, তামান্নার মা নাছিমা বেগম ও তাহমিনা আক্তারের মা তাজমহল বেগম। কী অসামান্য গানের কণ্ঠ আলমিনা আক্তার নিতুর! অভিনয়েও জুড়ি নেই ওর। অথচ এক সময় তার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। তখন তার বাবা-মাও ছিলেন কর্মহীন। বাবা মাহবুব আলম এখন বাঁধনহারা ফুডসে বাবুর্চি। মা আয়ার কাজ করছেন বিয়াম জিলা স্কুলে। তাদের অভাবের সংসারে এখন উপচে পড়ছে খুশির ঝিলিক। নিতু লেখাপড়া করছে। ভালোভাবে পড়াশোনা করায় প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে বিশেষ পুরস্কারও পেয়েছে সে।
নিতুর মতো কবির মিয়াও দরিদ্র পরিবারের সদস্য। বাবার সঙ্গে ফুটপাতে পিঠা বেচত সে। স্কুলে গেলেও এক সময় লেখাপড়ার খরচ জোটানো কঠিন হয়ে পড়ে বাবা-মায়ের। একদিন বাঁধনহারা ফুডসে চাকরি হয় তার। এখন সে স্থানীয় আইডিয়াল হাই স্কুলে অফিস সহকারীর কাজও করছে। ভর্তি হয়েছে নরসিংদী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে। ঝিনুক আক্তারের বাবা ছিলেন বেকার। মা কাজ করতেন স্থানীয় একটি কারখানায়। কিন্তু মায়ের উপার্জনের অর্থে সংসারের নিত্যপ্রয়োজনীয় চাহিদাই মিটত না। তাই বন্ধ হয়ে যায় ঝিনুকের লেখাপড়া। বাঁধনহারার ছোঁয়ায় সেই ঝিনুক এখন অনার্সের ছাত্রী। অবসরে শিক্ষকতা করছেন নরসিংদী কালেক্টরেট পাবলিক স্কুলে। তার বাবাও এখন অটোরিকশা চালিয়ে বেশ উপার্জন করছেন।
রিশাদ, নিতু, কবির ও ঝিনুক ছাড়াও বাঁধনহারায় রয়েছে তানজিনা আক্তার, সেবু আক্তার, উম্মে হানী নিশি, আলমগীর হোসেন শ্রাবণ এবং রবিউল হাসান হৃদয়ের গল্প। এখন বাঁধনহারা পরিচালিত হচ্ছে গ্রুপ থিয়েটারের আদলে। সাংস্কৃতিক চর্চার বিকাশ ও পেশাদার নাট্যচর্চার লক্ষ্যে সংগঠনটি নির্মাণ করেছে স্টুডিও থিয়েটার। তাদের জনপ্রিয় প্রযোজনা মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গীতিনাট্য 'যশোর রোড'। বাঁধনহারার ধ্রুপদী প্রযোজনা রবীন্দ্রনাথের 'সামান্য ক্ষতি'। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনভিত্তিক নাটক 'খোকা'ও দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রূপকল্প ২০২১-এর আলোকে এ সংগঠন নির্মিত 'ডিজিটাল বাংলাদেশ', 'দৈত্য হলো খেলার সাথী' নাটকের মঞ্চায়ন ও শৈল্পিক উপস্থাপনা প্রশংসা পেয়েছে। এসিড, সন্ত্রাস, বাল্যবিয়ে, ইভটিজিং, পরিবেশসহ বিভিন্ন বিষয়ে বেশ কয়েকটি ডকুমেন্টারি ড্রামাও রয়েছে তাদের।
বিভিন্ন টেলিভিশনে প্রায় নিয়মিত পরিবেশনা ছাড়াও শিল্পকলা একাডেমি, একুশের বইমেলা মঞ্চসহ ঢাকা অফিসার্স ক্লাব, বঙ্গবন্ধু নভো থিয়েটার, গুলশানের লেকশোর হোটেল ও কক্সবাজারে নাটক মঞ্চস্থ করেছে বাঁধনহারার সদস্যরা। সামনের দিনগুলোতে মুক্ত মঞ্চ নির্মাণের পরিকল্পনাও রয়েছে তাদের। সংগঠনটি শুধু নাটকেই তাদের কার্যক্রম সীমিত রাখেনি; কোরিওগ্রাফি, ফ্যাশন শো, মূকাভিনয়, নৃত্য, সঙ্গীত, একক অভিনয়, ক্ষুদ্র নাটিকাসহ শিল্প-সংস্কৃতির সব শাখায় তাদের সরব বিচরণ। আছে ছোট পাঠাগারও। কমিউনিটি রেডিও এবং অনলাইন টিভি চালুর চিন্তাও করছে তারা। এসব লক্ষ্য অর্জনে নিজেদের প্রস্তুত করে চলেছে তারা। চালু আছে চিন্তার দৈন্য ও অর্থনৈতিক পশ্চাৎপদতা থেকে মুক্তির সংগ্রাম। সূত্র: সমকাল


0 comments:

Post a Comment